
পাকিস্তান কেন বাংলাদেশের সঙ্গে দ্রুত সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী? আল-জাজিরার প্রতিবেদন!
প্রজ্ঞা নিউজ ডেস্ক:
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার গত ২৩ আগস্ট বাংলাদেশের ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এটি ছিল দীর্ঘ ১৩ বছর পর কোনো উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি কর্মকর্তার প্রথম বাংলাদেশ সফর।
ইসহাক দার পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছেন। তিনি এই সফরকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দেন এবং একে দুই দেশের সম্পর্কের ‘নতুন অধ্যায়’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এক ধরনের উষ্ণতা ফিরে এসেছে এবং গত এক বছরে ‘গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি’ হয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায়, ‘আমাদের এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেখানে করাচি থেকে চট্টগ্রাম, কোয়েটা থেকে রাজশাহী, পেশোয়ার থেকে সিলেট এবং লাহোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত তরুণ প্রজন্ম হাতে হাত মিলিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে ও যৌথ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে।’
এ সফরকে কয়েক মাস ধরে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে চলা কূটনৈতিক ও সামরিক যোগাযোগের বড় অগ্রগতি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে পাকিস্তানের সাবেক কূটনীতিক মাসউদ খালিদ সতর্ক করে বলেন, অতীতের জটিলতা এখনো দুই দেশের মধ্যে আস্থা তৈরিতে বাধা হয়ে আছে।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, বাংলাদেশের নতুন সরকার পাকিস্তানের উদ্যোগে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। স্পষ্টতই, ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পথে কিছু কৃত্রিম বাধা ছিল, যা এখন সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে এখন দরকার গভীরতর সম্পৃক্ততার একটি কাঠামো, যেখানে গঠনমূলক সংলাপ ভুল বোঝাবুঝি দূর করবে।
দুই দেশের সামরিক ও কূটনৈতিক যোগাযোগ
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ গত বছর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দুবার বৈঠক করেন। কিন্তু এত দ্রুত সম্পর্ক উষ্ণ হবে বা নিয়মিত উচ্চপর্যায়ের সফর হবে—এটা অনেক বিশ্লেষকই ভাবেননি।
গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান ইসলামাবাদে গিয়ে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান পাকিস্তান সফর করেন। দুই মাস পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালোচ ঢাকায় আসেন।
গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তানের চারদিনের সংঘর্ষের কারণে ইসহাক দারের সফর বিলম্বিত হয়। তবে জুলাইয়ে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভি ঢাকায় আসেন।
অবশেষে আগস্টে ঢাকায় পৌঁছান ইসহাক দার। একই সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান পাকিস্তান সফর করেন এবং সেখানে যৌথ প্রধান সেনাপতি কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মিরজার সঙ্গে বৈঠক করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দিলওয়ার হোসেন বলেন, পাকিস্তানের এই ‘তড়িঘড়ি প্রচেষ্টা’ কৌশলগত। হাসিনা সরকারের সময়ও পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইছিল। এখন তারা ১৯৭৫–পরবর্তী সময়কার সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের সুযোগ দেখছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের কারণে পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক বেশ জটিল। পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীরা পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়, লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে এবং আনুমানিক দুই লাখ নারীকে ধর্ষণ করে। ভারতের সামরিক সহায়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
টানা ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন ভারতের ঘনিষ্ঠ। তার ক্ষমতাচ্যুতির পর পাকিস্তান আবারও সুযোগ দেখছে। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব আজাজ চৌধুরীর মতে, ভারতীয় আধিপত্যের অভিজ্ঞতা পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে এক করেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশিরা ভারতীয় আধিপত্য টের পেয়েছে, আমরাও মে মাসের সংঘাতে সেটা দেখেছি। এখন দুই দেশই দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তা বুঝছে।
তবে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক শাহাব এনাম খানের মতে, বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতি অর্থনৈতিক বাস্তবতার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ভারত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হলেও সম্পর্ক এখন শীতল। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে সম্পর্ককে শুধু নিরাপত্তা বা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে না, বরং অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতায় জোর দেয়।
চীনের ভূমিকা
দক্ষিণ এশিয়ার সমীকরণে চীনের প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ। বেইজিং পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র, আবার হাসিনার সময়ও বাংলাদেশে তাদের দৃঢ় অবস্থান ছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও চীন বাংলাদেশে প্রভাব ধরে রেখেছে। মার্চে ড. ইউনূস বেইজিং সফর করেন, আগস্টে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান চীন সফরে যান।
বাংলাদেশ ১২টি জে-১০সি যুদ্ধবিমান কেনার বিষয় বিবেচনা করছে, যা পাকিস্তানের কাছেও রয়েছে এবং মে মাসের সংঘাতে পাকিস্তান তা ব্যবহার করেছে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ঋণ, বিনিয়োগ ও সামরিক সরঞ্জামের সবচেয়ে বড় উৎস চীন।
ঢাবি অধ্যাপক দিলওয়ার হোসেনের মতে, এ বিষয়গুলো ঢাকা এবং ইসলামাবাদকে আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলছে এবং সম্পর্ককে একটি শক্তিশালী অংশীদারত্বে রূপান্তরিত করছে।
বাণিজ্য ও রাজনীতি
ইসহাক দারের দুদিনের সফরে তিনি ড. ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির নেতারাও এর মধ্যে ছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের শুরুর দিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফলে এসব বৈঠক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দুই দেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করলে উভয়ই উপকৃত হতে পারে। বর্তমানে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে পাকিস্তানের প্রাধান্য রয়েছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানের রপ্তানি ছিল ৬৬ কোটি ১০ লাখ আমেরিকান ডলারের, বিপরীতে আমদানি মাত্র ৫ কোটি ৭০ লাখ ডলারের।
বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে তুলা, বস্ত্রপণ্য, চাল, সিমেন্ট, ফলমূল ও প্রক্রিয়াজাত খাবার আমদানি করতে পারে। অন্যদিকে, পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে পাটজাত পণ্য, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, রাসায়নিক ও তামাকজাত পণ্য আমদানি করতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিলওয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্মিলিত জনসংখ্যা প্রায় ৪৩ কোটি, যা পশ্চিম ইউরোপের দ্বিগুণেরও বেশি।
১৯৭১ সালের ক্ষত
তবে সবচেয়ে বড় জটিলতা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের উত্তরাধিকার। বাংলাদেশ এখনো পাকিস্তানের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করে। এছাড়া আছে প্রায় দুই লাখ উর্দুভাষী বিহারির বিষয়, যাদের পাকিস্তান গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক।
এছাড়া ১৯৭১–পূর্ব রাষ্ট্রীয় সম্পদের ভাগ এবং ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেটি চায় বাংলাদেশ। ইতিহাসবিদদের মতে, তৎকালীন সরকারের ধীর ও ব্যর্থ সাড়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অনুঘটক হয়।
তবুও পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব আজাজ চৌধুরী মনে করেন, দুই দেশের সাধারণ মানুষ পুনর্মিলন চায়। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ঘটনাবলিতে পাকিস্তানের মানুষও দুঃখিত। এই বেদনা দুই দেশের জন্যই সাধারণ, আর এখন মানুষ এগিয়ে যেতে চায়।
তবে দিলওয়ার হোসেন মনে করিয়ে দেন, হাসিনার পতনে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত মনোভাব মৌলিকভাবে বদলায়নি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখনো পাকিস্তানের কাছ থেকে অতীতের ক্ষত সারানোর প্রত্যাশা রাখে।
তবে ঢাকা অতীতে আটকে থাকতে চায় না। ঢাবি অধ্যাপকের কথায়, কূটনীতি একটি চলমান প্রক্রিয়া। অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি অতীতের ক্ষত সারানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা সম্ভব। সূত্র:আল-জাজিরা